Thursday, 16 August 2018

তসলিমার একটি লেখা



আমি রাজনীতির বেশি কিছু বুঝি না। যখন শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ বাজে রেডিওতে, এটুকুই বুঝি আমার ভালো লাগে। রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় উত্তেজনায়। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম যেন নিছক স্লোগান নয়, রক্তে তুফান তোলা কবিতা। ইস্কুলে গানের ক্লাসে গাই জয় বাংলা বাংলার জয়। এ তো নিছক গান নয়, অন্য কিছু। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠার কিছু। পাড়ায় কদিন পর পরই প্যান্ডেল খাটিয়ে নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়, ছুটে যাই মাইকে গানের আওয়াজ পেলেই। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছেলে মেয়েরা গান করে, নাচে। কী যে সুন্দর দেখায় ওদের! গানগুলো বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়। ক্ষুদিরামের গান শুনলেও এমন হত। ক্ষুদিরামের গল্প বলতেন কানা মামু, দেশ স্বাধীন করার জন্য এক ছেলে ইংরেজ বড়লাটকে বোমা মেরে ফাঁসিতে ঝুলেছিল। আমারও ক্ষুদিরামের মত হতে ইচ্ছে করে। অমন সাহসী, অমন বেপরোয়া।
হঠাৎ একদিন, সে সময় হঠাৎই, পুরো শহর থমথম করে। পাড়ার লোকেরা রাস্তায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। যেন পৃথিবী ধসে পড়ছে আর দুমিনিট পর এ পাড়ার মাথায়। কারও কারও কানে রেডিও। মুখ শুকনো। চোখ গোল। কি হল কি হল। আবার কী! কান পেতে রেডিও শোনার দিন তো শেষ একাত্তরে, চারটে বছর কেবল পার হল, এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ গেল, ভাঙা সেতু ভাঙা রাস্তা ঘাট সারাই হচ্ছে, কী হল তবে আবার! দেশ থমথম করলে লোকের অভ্যেস রেডিওতে বিবিসি শোনা। দেশের খবরে এ সময় কারও আস্থা থাকে না। লোকে যা করে, বাবাও তা করেন। আমাকে রেডিওর নব ঘোরাতে বলেন বিবিসির খবর ধরতে, বড় একটি দায়িত্ব পেয়ে খানিকটা গৌরব হয় আমার। আমাকে কখনও পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু করার আদেশ বাবা দেন না। জগত সংসারের অন্য কিছুতে আমাকে ডাকা হয় না। নব ঘোরানোর কাজ সব দাদার কিংবা ছোটদার। আমার কেবল দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। দাদা নেই বাড়িতে, চাকরির কারণে শেরপুর গেছেন দুদিনের জন্য। ছোটদা তো নেইই। নেই বলে আমি আজ নতুন রেডিওর নব ঘোরানোর দায়িত্ব পেয়েছি। বিবিসির কাছাকাছি এলে বাবা বলেন থাম থাম। শব্দ ভেসে আসে ঈথারে, ভাঙা শব্দ, অর্ধেক উড়ে যাওয়া শব্দ।
শেখ মুজিব নিহত।
কেবল তাই নয়, পরিবারের প্রায় সবাইকে কারা যেন গুলি করে মেরে রেখেছে তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। এ কী হল! এও কি সম্ভব! কপালের শিরা চেপে বসে থাকেন বাবা।
মা ঘরময় হাঁটেন অস্থির, আর থেকে থেকে বলেন, এই টা কি অমানুষের মত কাজ। ছেলে ছেলের বউ এতটুকু বাচ্চা ছেলে রাসেল সবাইরে মাইরা ফেলল! তারা কী দোষ করছিল? কী পাষণ্ড গো বাবা। কী পাষণ্ড!
এখন কি দেশটা আবার পাকিস্তান হইয়া যাইব?
প্রশ্নটি বাবার দিকে ছুঁড়ে দিই। কোনও উত্তর ফেরত আসে না। তিনি কপালের শিরা চেপে তখনও।
মা, কও না কেন, দেশটা কি পাকিস্তান হইয়া যাইব নাকি!
যেন বাবা মা সব উত্তর হাতে বসে আছেন। তাই কি হয় কখনও! মা বলেন, বংশ নির্বংশ কইরা ফেলাইছে রাইত দুপুরে। আল্লায় এদের বিচার করবেন।
বাবা তখনও শিরা চেপে। এরমধ্যে সাত সকালে বাবার কাছে পাড়ার দুজন লোক আসেন। মাখন লাল লাহিড়ী আর এম এ কাহহার, মুন্নির বাবা। বৈঠক ঘরে বসে সকালের চা খেতে খেতে তাঁরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কঠিন কঠিন কথা বলেন। দরজার আড়াল থেকে শুনে আমি তার কতক বুঝি, কতক বুঝি না। বড়রা আমাকে তাঁদের আলোচনায় টানেন না আমি যথেষ্ট বড় হইনি বলে অথবা আমি মেয়ে বলে, কে জানে!
ঘরে টানানো তর্জনি তোলা শেখ মুজিবের ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমার বড় মায়া হতে থাকে। মানুষটি কাল ছিল, আজ নেই—বিশ্বাস হতে চায় না। রেডিওতে আর জয় বাংলা গান বাজে না। আমার ভয় হতে থাকে। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি। এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল, এই বুঝি আমাদের মোষের গাড়ি করে আবার পালাতে হবে কোথাও! এই বুঝি শহরের রাস্তায় কামান চলবে, এই বুঝি গুলি করে যাকে ইচ্ছে তাকে মেরে ফেলা হবে। এই বুঝি আমার শরীরে টর্চ ফেলে দেখবে কেউ, ঠাণ্ডা একটি সাপ ঢুকে যাবে আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।
সময় এক রাতেই পাল্টে গেছে, শেখ মুজিবের নাম নেওয়া বারণ। জয় বাংলা বলা বারণ। আমার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। বৈঠক ঘর থেকে বাবার থেকে থেকে কী যে হইব ভবিষ্যত! হামাগুড়ি দিয়ে আসতে থাকে ভেতর ঘরে।’
ওপরের লেখাটুকু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের স্মৃতি থেকে। স্মৃতিকথা লিখেছিলাম নব্বইয়ের দশকে। বই হয়ে বেরিয়েছিল। বইটিতে আমার দেখা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরও স্মৃতি আছে, কী করে আমরা একাত্তরের ন’মাস এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কী করে একদিন দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ করেছি। এখানে সামান্য উল্লেখ করছি—
‘মুক্তিবাহিনীরা শেষ অবদি স্বাধীন করেছে দেশ। আমরা তখন দাপুনিয়া নামের এক গ্রামে। শীতের সকালে বৈঠক ঘরের দাওয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছি, হঠাৎ শুনি চিৎকার। চিৎকারের উৎস দেখতে পাকা রাস্তার দিকে দৌড়োই। কান পেতে থেকে বুঝি উৎস ক্রমে ক্রমে এগোচ্ছে এদিকেই। লোকের চোখে কৌতূহল, কী হল, কী হল, কারা আসে আবার দাপুনিয়ায়! আবার কি আসছে ঘর পোড়ার খবর, লাশের খবর! গত সাতদিন ধরে নাগাড়ে গুলির শব্দ শুনে দাপুনিয়া গ্রামের কানে তালা লেগে গেছে। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে দাপুনিয়া শ্বাসের মত করে শ্বাস নেয়নি। এখন কে আসে চিৎকার করে এই গ্রামে! কে আসে এই সকালে পাকা রাস্তা ধরে? মিলিটারি? না, এ ঠিক মিলিটারির শব্দ নয়। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এ ওর। বাড়ির মেয়েরা জানলার পর্দা ফাঁক করে তাকিয়ে থাকে এখনও না আসা উৎসের দিকে।
উৎস এগোতে থাকে দাপুনিয়া বাজারের দিকে, বন্দুক হাতে বিশ পঁচিশজন যুবক, ট্রাকে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। কী তেজি এই রোল, কী বিবশ করা এই উত্তেজনা! দাপুনিয়ার স্তব্ধতা চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ে। মানুষ যেন আঁধার গুহা থেকে এক যুগ পর বেরিয়েই দেখছে আলো ঝলকানো জগত। হিম-ঠাণ্ডা নদীতে ডুবতে ডুবতে হাতের কাছে পেয়েছে পাল তোলা নৌকো। দাপুনিয়া গ্রামের মানুষ এতকাল মনে মনে, বড়জোর ফিসফিসিয়ে এ ওর কানে কানে বলেছে জয় বাংলা। আজ তারা হররা শুনছে জয় বাংলার। ত্রাসের চাদর ছুঁড়ে ফেলে মানুষ গলা ফাটায় জয় বাংলা বলে। আমিও। ওদের মত হাতের মুঠি তুলে চিৎকার করি। মানুষ ছোটে ট্রাকের পেছন পেছন, জয় বাংলার পেছন পেছন, মুক্তির পেছন পেছন। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকি মা’কে খবর দিতে। মা জানালায় দাঁড়িয়েছিলেন। দু’পাক নেচে বলি—মা জয় বাংলা কও। দেশ স্বাধীন অইছে। মা হাসছেন আর মা’র গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে। আঁচলে মুছছেন জল, আবারও ঝরছে। আবারও হাসছেন তিনি। একই মুখে হাসি, কান্না দুটোই।
রাস্তায় এখনও জটলা, মানুষ দৌড়োচ্ছে, জয় বাংলা জয় বাংলা বলে দাপুনিয়া মাথায় তুলছে। কাল ছিল গুলির শব্দ, মরাকান্না, আজ হাসি, আজ উল্লাস, আজ হৈ হৈ, আজ জয় বাংলা। জয় বাংলা মানে কেউ আর কারও বাড়ি পুড়িয়ে দেবে না, আর কেউ কাউকে গুলি করবে না, কোথাও আর বোমা পড়বে না, কেউ আর কাউকে ধরে নিয়ে যাবে না চোখ বেঁধে, বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসবে না, আকাশে ভিড় করবে না শকুনের দল, আমরা ফিরে যাব শহরের বাড়িতে, আমার ফেলে আসা ঘরটিতে ঘুমোব কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে, আমার মাপুতুল মেয়েপুতুল এখনও ওদের ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে আছে, গিয়ে ওদের ঘুম ভাঙাব।

উত্তেজনা আমার পেছন পেছন নাকি আমি তার পেছন, নাকি উত্তেজনা আমার কাঁধের ওপর, নাকি আমি তার কাঁধের ওপর, না বুঝেই দৌড়ে যাই আবার সেই জটলার দিকে, মিছিলের দিকে। মিছিলে খালেদকে দেখি সবার সামনে, হাতে বাঁশের কঞ্চির ওপর বাঁধা পতাকা, সবুজের মধ্যে লাল এক গোল্লা, গোল্লার মধ্যে তোবড়ানো হলুদ কাপড়। খালেদের পেছন পেছন গ্রামের কিশোর-কিশোরী, যুবক বৃদ্ধের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ছটকুর হাতেও দেখি ঠিক ওরকম এক পতাকা। আমারও ইচ্ছে করে একটি পতাকা হাতে পেতে।
মিছিল শেষ করে রাস্তার কিনারের এক কাঁঠাল গাছের ডালে চড়ে হাতের পতাকাটি উড়িয়ে খালেদ বলেন—এইটা হইল জয় বাংলার পতাকা। এখন থেইকা এইটাই আমাদের পতাকা। সবাই বল জয় বাংলা। সবুজ রং হচ্ছে গিয়া আমাদের সবুজ ধানখেত, মধ্যে লাল সূর্য, আর সূর্যের মাঝখানে আমাদের মানচিত্র। নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা একটা দেশ পাইছি, দেশের নাম আজ থেইকা পূর্ব পাকিস্তান না, দেশের নাম জয় বাংলা। সবাই বল জয় বাংলা।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাক সেনারা আমাদের শহরের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে ঢুকে কী করে আমার বাবাকে মেরে আধ-মরা করে রেখেছিল, কী করে আমাদের সোনাদানা টাকা পয়সা লুট করেছিল—সব লেখা আছে, ‘আমার মেয়েবেলা’ নামের বইটিতে। এই বইটি বিদেশে নানা পুরস্কার পেলেও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নব্বইয়ের দশকে নিষিদ্ধ করেছেন, বইটি আজও নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ করার কারণ, তিনি বলেছেন, অশ্লীলতা। যখন আমার সাত বছর বয়স, আমার এক বয়স্ক আত্মীয় আমাকে যৌন হেনস্থা করেছিল। সেটির বর্ণনা আছে একটি প্যারাগ্রাফে, সেই বর্ণনাকেই তিনি সম্ভবত অশ্লীল বলে গণ্য করেছেন। সেটি কিন্তু অশ্লীলতা নয়, সেটি কঠোর বাস্তবতা। আজও মেয়েরা প্রতিদিন যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে। এই হেনস্থার কথা আমরা যদি মুখ ফুটে না বলি, তবে কে বলবে? হেনস্থার কথা বলা মানে হেনস্থার প্রতিবাদ করা। অন্যায়ের প্রতিবাদ যত বেশি হবে, তত বেশি বন্ধ হবে অন্যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করুন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এবং নারী নির্যাতনের বিপক্ষে লেখা এই বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন।
            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা